বাড়ি, ভাড়ার জন্য
-অনিন্দ্য ভুক্ত
এরে যে কেন স্ত্রীধন কয় তা আজো বুঝে উঠতে পারলেন না রামচন্দ্রবাবু।
অবিশ্যি ধনসম্পত্তি ব্যাপারটাই এমন গোলমেলে। সেদিন নিবারণ বলছিল, ইংরেজিতে ক্রেডিট বলে একটা শব্দ আছে, তাতে নাকি দেনাও বোঝায়, পাওনাও বোঝায়। মানে ধনসম্পত্তি যোগ হলেও ক্রেডিট, বিয়োগ হলেও ক্রেডিট। সামলাও ঠেলা।
এমন ঠেলা অবশ্য ইতিপূর্বে একবার জোর সামলে ছিলেন। সেটা ছিল পৈতৃক সম্পত্তির ঠেলা। সম্পত্তি নিয়ে যে এমন ঠেলাঠেলি হতে পারে পিতৃদেবের মৃত্যুর আগে তা টের পাননি। সে একবারে জোর ধাক্কা। ইকনমিক্সের ভাষায় ‘বিগ পুশ’।
স্বর্গীয় দশরথ আলুর একদা আরেক বিগ পুশে তাঁকে ইকোনমিক্সটাও পড়তে হয়েছিল কিনা! তখনই বুঝেছিলেন এটা একটা সাবজেক্টের মতো সাবজেক্ট বটে। নাম শুনলেই লোকে বেশ ভক্তি ছেরাদ্দ করে। তো ধনসম্পত্তির কথা সেখানেই পড়েছিলেন। ব্যাপারটা অতএব গোলমেলে না হয়ে যায় কোথা।
অবিশ্যি এতো পড়েও তাঁর লাভ বিশেষ হয়নি, কেবল এই ব্যাঙ্কের কেরানিগিরির চাকরিটুকু ছাড়া। নইলে স্ত্রীধন শব্দটা শুনেই তাঁর টের পাওয়া উচিত ছিল, স্ত্রী নামক বস্তুটি কেমন ভয়ঙ্কর হতে পারে। ইকনমিক্স তো ততদিনে পড়া হয়ে গেছে।
কিন্তু টের পাবেন কি করে? পাত্রী দেখতে গিয়ে পাত্রীর একটা মুগ্ধ চোরাচাউনিতে ঘায়েল হয়ে তখন তো তিনি ছাঁদনাতলার দিকে ন্যাংচাতে শুরু করেছেন। অবিশ্যি ধন শব্দটার তো এখানেই মাহাত্ম্য। প্রথমে খেলিয়ে খেলিয়ে কাছে টানে, তারপর পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে পঞ্চানন বানিয়ে ছাড়ে।
বহুক্ষণ হাঁটছেন। হাতের কাছে একটা বাড়ির রোয়াক পেয়ে ধপ করে বসে পড়লেন রামচন্দ্রবাবু। এই উত্তর কলকাতার পুরোনো বাড়িগুলো যতোদিন টিঁকে আছে, বাড়ীর রোয়াকও ততদিন টিঁকে থাকবে। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ছ্যাকায় পৃথিবী ঝলসে যাবার আগেই কি রোয়াক সব উঠে যাবে? মনে মনে পুরোনো দিনের মানুষগুলোর বুদ্ধির তারিফ করলেন। তখনও তো এসব গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের গল্প কেউ শোনেনি। অথচ ঠিক যেন আজকের দিনটার কথা ভেবেই বউয়ে খ্যাদানো রামচন্দ্রবাবুদের কথা ভেবেই রোয়াকগুলো বানিয়েছিল সব।
বাপস রে কি গরমখানাই পড়েছে আজ! রামচন্দ্র আলু যে রামচন্দ্র আলু, গরমে যাঁকে কেউ কখনো কাবু হতে দেখেনি, তাঁর পর্যন্ত আজ গেঞ্জী নিঙরোলে কমসে কম হাফ লিটার ঘাম বেরিয়ে যাবে। এসব নাকি গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ফল।
শব্দটা সদ্য শিখছেন রামচন্দ্রবাবু। না শিখে উপায় আছে! গরম পড়া ইস্তক কাগজওলারা তো শুধু এই এক বুলিই কপচে যাচ্ছে। অফিসের ছোকরা ছেলেগুলো পর্যন্ত একদিন একটা সেমিনার করে ফেললো। এদের ব্যাপার স্যাপার দেখে বাবার কথা মনে পড়ে যায়। বাবা তাঁর সম্বন্ধে একটা শব্দ প্রায়ই ব্যবহার করতেন। উল্লুক। তার মানে কি, তখন বুঝতেন না। শুধু বুঝতেন সেটা একটা জন্তু বিশেষ। কেমন সে জন্তু আজো জানেন না, তবে ইদানিং তাঁর সব দু’পেয়েকেই উল্লুক বলে ঠাহর হচ্ছে। এক্ষুণি আলিপুর ঝড়বৃষ্টি আপিস একটা বৃষ্টির নিদান হাঁকুক, এসব সেমিনার-টেমিনার ঝটপট সব গুটিয়ে নেবে, ঠিক যেমন ফুটপাতের হকাররা পুলিশ দেখলে করে।
ফুটপাতের হকারের কথা মাথায় আসতেই নিজেকে তাদেরই একজন মনে হলো। সবে রোববারের সকালের বাজারটা সেরে, টিফিন খেয়ে, ফ্যানের তলায় কাগজটা নিয়ে বসেছিলেন, প্রায় গলাধাক্কা দিয়ে ফুটপাতে নামিয়ে দিল!
আজকাল রত্নাকে দেখলেই তাঁর কেমন ভয় ভয় করে। আজও যখন মেঝেয় ছড়ানো কাগজটার উপর দশাসই একটা ছায়া এসে পড়েছিল, বুকটা কেঁপে উঠেছিল। মুখ তুলে দেখেছিলেন ভদ্রমহিলার মুখে যেন বর্ষার মতো মেঘ এসে ভিড় করেছে। এই একটা ব্যাপারে রত্না যেন আরো পটু হয়ে উঠেছে। আগে তন্বী যুবতীর শরীরের খাঁজে খাঁজে ইঙ্গিত খেলা করতো। এখন পৃথুলা রমনীর মাংসের তালগুলো ইঙ্গিত পরিবহনে অক্ষম হয়ে পড়ায় মুখখানাই শেষ অস্ত্র হয়ে উঠেছে।
রামচন্দ্রবাবু তখনই প্রমাদ গুনেছিলেন। ধপ করে বরের পাশে বসে পড়ে বর্বরের মতো তার গলা জড়িয়ে নিজের অপমানিত হওয়ার গল্প শুনিয়েছিল রত্না। বাড়িউলি তাকে নাকি যৎপরোনাস্তি অপমান করেছে। তার কোনো দোষ নেই। ছাদে বাড়িউলির তারটা ফাঁকা ছিল বলে সে নাকি কেবল একটাই লুঙ্গি রোদে দিয়েছিল।
বাকি গল্পটা রামচন্দ্রবাবুর মোটামুটি জানা ছিল। ফি বছরই তাঁকে এটা শুনতে হয় কিনা! প্রথমে গল্পটা বলতে বলতে ফোঁসফাঁস, তারপর তিনি বোঝানোর চেষ্টা করলে বজ্রহুঙ্কার, আর শেষে রাজী না হলে অনশন ধর্মঘট। ছকটা চেনা হয়ে গেছে বলে আজকাল আর প্রথম ধাপের পর এগোতে চান না। কিন্তু আজ এই গরমের ভয়ে একটু কুঁইকাঁই করেছিলেন। ব্যস, ঝট করে নাটক দ্বিতীয় অংকে পৌঁছে গেল। গত এক বছরে তিনি যে আরেকটু পুরোনো হয়ে গেছেন, খেয়াল ছিল না রামচন্দ্রবাবুর। হুঙ্কার সহযোগে এবারে একেবারে মেঝে থেকে গেঞ্জী ধরে টেনে তুললো!
সেই থেকে ঘুরছেন। আজকাল বাড়িভাড়া পাওয়া কি চাট্টিখানি কথা নাকি? এক তো খালি বাড়ি পাওয়া যায় না, তারপর যদি বা পাওয়া গেল, শুরু হবে প্রশ্নমালা। কি পরিচয়, রাবণের গুষ্টি নাকি টোনাটুনি, কেন পাল্টাচ্ছেন বাড়ি? এই শেষ প্রশ্নটা এলেই সিঁটকে যান রামচন্দ্রবাবু। দিনকে দিন যা নাম করে ফেলছে রত্না, এবার গোটা কোলকাতা শহরে বাড়ি মিললে হয়!
গরমের ঝোঁকটা একটু কাটলেও, উঠতে আর ইচ্ছে করছিল না। বসে বসে শেষ প্রশ্নের উত্তরটা মকসো করছিলেন। এমন সময়ই চোখ গেল দড়িতে ঝোলানো কাগজের বোর্ডটার দিকে, ‘টু লেট’। যে বাড়ির রোয়াকে বসে আছেন, তার ঠিক উল্টো দিকের বাড়িতে। আরে, এতোক্ষণ চোখে পড়েনি! গরমে কি চোখে সর্ষে ফুল দেখছিলেন নাকি?
তড়াক করে উঠে গিয়ে দরজার কড়া নাড়লেন।
‘কে-এ-এ’ বলে যিনি এসে দরজা খুললেন তাঁকে দেখেই রত্নার কথা মনে পড়ে গেল।
– কি চাই?
– আজ্ঞে, ভাড়া।
–ভাড়া! বাড়ি তো ভাড়া হয়ে গেছে হপ্তাখানেক হলো।
গরমটা যে এখনো শরীর থেকে নামেনি সেটা টের পেলেন রামচন্দ্রবাবু। ঝট করে দরজার বাইরে গিয়ে ঝোলানো বোর্ডটা টেনে এনে ভদ্রমহিলার চোখের সামনে রীতিমতো নাচাতে শুরু করে দিলেন,
– তাহলে এটা কি, বলি তাহলে এটা কি?
– য়্যাঁ!
ধপ করে বসে পড়লেন ভদ্রমহিলা। বসেই চীৎকার ছাড়লেন, ‘ঝিল্লি-ই-ই’।
ঝিল্লি বোধহয় পাশের ঘরেই ছিল। হয়তো কথাবার্তা শুনেও থাকবে। সে যখন ঘরে ঢুকলো, ভদ্রমহিলাকে বাগে পাওয়া গেছে ভেবে রামচন্দ্রবাবু তখনও প্রবল পরাক্রমে বোর্ডটা নেড়ে যাচ্ছেন।
– এটা কি, এটার মানে তাহলে কি?
ঘরে ঢুকে পরিস্থিতি বুঝতে ঝিল্লি ঠিক দশ সেকেন্ড সময় নিল। তারপর ঝিলিক করে বোর্ডটা রামচন্দ্রবাবুর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে সেটা উল্টো করে ধরে, ভেংচি কেটে বললো,
–এটার মানে ‘টু লেট নয় স্যার, এটার মানে ‘টু-উ-উ লেট’। আপনি বড্ডো দেরী করে ফেলেছেন।
রামচন্দ্রবাবুর মনে হলো রত্না আবার তাঁর গেঞ্জী ধরে খ্যাঁচকা টান মারলো।